
সময়েরপাতাঃ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে শিল্পনগরী টঙ্গী এখন জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। লাখো মুসল্লির পদভারে মুখরিত টঙ্গী। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ধ্বনি টঙ্গীর আকাশে-বাতাসে। আজ বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যে আখেরি মোনাজাত হবে বলে আয়োজক কমিটি জানিয়েছে। তাবলীগ জামাতের শীর্ষস্থানীয় মুরুব্বি দিল্লির মারকাজের শূরা সদস্য হযরত মাওলানা মুহাম্মদ সা’দ আখেরি মোনাজাত পরিচালনা করবেন। ওদিকে তাবলীগ জামাতের শীর্ষ মুরুব্বিদের গুরুত্বপূর্ণ বয়ান ও মুসল্লিদের জিকির আসগারের মধ্য দিয়ে গতকাল বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিন অতিবাহিত হয়েছে। বয়ান করেছেন দেশ বিদেশের মাওলানারা। বয়ানে তারা দুনিয়ার মিছে আরাম-আয়েশের কথা ভুলে গিয়ে আখেরাতের কথা চিন্তা করার কথা বলেছেন। বয়ানে দ্বীনের দাওয়ার দেয়ার প্রতিও তাগিদ দেয়া হয়েছে।
আখেরি মোনাজাতে অংশ নিয়ে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য গোনা মাফ চাইতে এবং পরকালের শান্তি কামনায় শরিক হতে তাবলীগ অনুসারী দেশি-বিদেশি মুসল্লিরা ছাড়াও দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মানুষ ট্রেন, বাস, ট্রাক, লঞ্চ, নৌকাযোগে ও পায়ে হেঁটে দলে দলে ইজতেমাস্থলে এসে যোগ দিচ্ছেন। তুরাগ নদীর তীরে ১৬০ একর জমির ওপর নির্মিত বিশাল প্যান্ডেল গতকালই কানায় কানায় ভরে গেছে। আজ আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের বসার জায়গা না পেয়ে জায়গা করে নিতে হচ্ছে ইজতেমা এলাকার চারপাশের বিভিন্ন খালি জায়গায়, মিল-কারখানার ভেতর ও সড়ক মহাসড়কে। আগামী ২০শে জানুয়ারি শুক্রবার থেকে শুরু হবে বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব।
বয়ান: গতকাল বাদ জোহর মাওলানা মুশস্তাক ইমান, আমল, জাহান্নাম, জান্নাত ও দাওয়াতে মেহনতের ওপর গুরুত্বপূর্ণ বয়ান রাখেন। তিনি বলেন, দুনিয়ার জীবন ক্ষণস্থায়ী। মহান আল্লাহ্র কাছে আমল ছাড়া দুনিয়ার জিন্দিগির কোনো মূল্য নেই। দুনিয়ার কামাই রোজগার দুনিয়াতেই কাজে লাগবে, আখেরাতে কোনো কাজে লাগবে না। যখন মায়ের পেটে ছিলাম তখন বুঝতে পারিনি পৃথিবী যে এত বড়। আবার পৃথিবী থেকে বুঝতে পারছি না যে আখেরাত কত বড়। তিনি আরো বলেন, জান্নাত হলো চিরস্থায়ী শান্তির জায়গা। জান্নাতে একবার কেউ গেলে সেখান থেকে আর বের হবে না। জান্নাতের জমিনের ঘাস হবে জাফরানের মতো। জান্নাতের ইটের জোড়া (গাঁথুনি) হবে রুপার, আর প্লাস্টার হবে হিরা-মুক্তা-জহরত দিয়ে। দুনিয়ায় যার যে পরিমাণ গোনাহ হবে পরকালে সেই পরিমাণ শাস্তি ভোগ করবে। তাবলীগ জামাতের মুরুব্বি মাওলানা মুশস্তাক হক অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে তার বয়ানে বলেন, মহান আলাহর প্রতি কারোনের কোনো বিশ্বাস ছিল না। সে নিজের অর্জিত সম্পদকে আল্লাহর সম্পদ বলে স্বীকার করতো না। বরং নিজেকে এসব সম্পদের একচ্ছত্র মালিক মনে করতো। তার সেই সম্পদ দুনিয়ায় কোনো কাজে আসেনি। ইমান আমল আখলাক ভালো থাকলে এবং দুনিয়ার সম্পদ আলাহর পথে কুরবান করলে আখেরাতে কামিয়াব হওয়া যায়। জান-মাল আলাহর পথে খরচ করলে আল্লাহ আরো বাড়িয়ে দেন। মাওলানা মুশস্তাক দুনিয়ার ভিআইপিদের নিয়ে গর্ব অহঙ্কারের বিষয় তুলে ধরে তার বয়ানে আরো বলেন, দুনিয়ায় যত ভিআইপি আছে সবাইকে একসঙ্গে ওজন দিলে একজন নবী রাসুলের (সা.) একটি আঙুলের সমানও হবে না। তিনি আরো বলেন, মানুষ যদি মহান আল্লাহর হেদায়েতনামা মেনে চলে তাহলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াব হবে। দুনিয়ার মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার জন্য যুগে যুগে নবী রাসুল পাঠানো হয়েছে এবং আল্লাহ প্রদত্ত জীবন বিধানও পাঠানো হয়েছে। দাওয়াতের মাধ্যমে মানুষের ইমান মজবুত হয়। ইমান মজবুত হলে আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠে। আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠলে দুনিয়া ও আখেরাতে কামিয়াবি হয়।
যৌতুকবিহীন বিয়ে হচ্ছে না: বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় দিনে যৌতুকবিহীন বিয়ের আয়োজন করার রেওয়াজ থাকলেও এবার তা হচ্ছে না বলে জানিয়েছে আয়োজক কমিটি। তাবলিগের রেওয়াজ অনুযায়ী প্রতিবছর ইজতেমার দ্বিতীয় দিন বাদ আসর নামাজের পর ইজতেমার বয়ান মঞ্চের পাশে বিয়ের আসর বসতো। বর ও পাত্রীপক্ষের উপস্থিতিতে এসব বিয়ে অনুষ্ঠিত হতো। কিন্তু গত বছর থেকে এ রেওয়াজ হচ্ছে না। ইজতেমা আয়োজক কমিটির মুরুব্বি মো. গিয়াস উদ্দিন জানান, ইসলামিক শরিয়া অনুযায়ী প্রতি বছর যৌতুকবিহীন বিয়ে দেয়া হলেও ৫১তম ইজতেমার পর্ব থেকে তা বন্ধ করা হয়েছে। তিনি জানান, ইজতেমা ময়দানে বিয়ে হলে তা এলাকাবাসীসহ অনেক স্বজন জানতে পারে না বলে এ ধরনের বিয়ের আকর্ষণ কমে গেছে। এজন্য ইজতেমা ময়দানে যৌতুকবিহীন বিয়ের জন্য তালিকায় নাম দিলেও তাদের এলাকায় গিয়ে বিয়ের আয়োজন করতে বলা হয়েছে।
বিদেশি মুসল্লি: শনিবার সকাল পর্যন্ত ৯৬টি দেশের প্রায় ১৫ হাজার বিদেশি মেহমান ইজতেমা ময়দানে উপস্থিত হয়েছেন বলে জানান ইজতেমা আয়োজক কমিটি। তারা ইজতেমা ময়দানের উত্তর পশ্চিম প্রান্তে নির্ধারিত কামরায় অবস্থান করছেন।
২ মুসল্লির মৃত্যু: খোরশেদ আলম (৬৫) ও তারা মিয়া (৭০) নামের দুই মুসল্লির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ইজতেমা ময়দানে দায়িত্বরত মুরুব্বিরা জানান, খোরশেদ আলম শুক্রবার সন্ধ্যায় ও তারা মিয়া গতকাল সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। মৃত খোরশেদ আলমের বাড়ি ফেনী জেলার দাগনভূঁইয়ায়। তারা মিয়ার বাড়ি বাহ্মণবাড়িয়া জেলা সদরে। এ নিয়ে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় ৭ মুসল্লির মৃত্যু হয়েছে।
যানবাহন নিয়ন্ত্রণ: আজ রোববার আখেরি মোনাজাতে অংশ নিতে আসা মুসল্লিদের অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য দক্ষিণে আন্তর্জাতিক হজরত শাহজালাল বিমানবন্দর, পশ্চিমে উত্তরা-১১নং সেক্টর, উত্তরে বোর্ড বাজার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, চৌরাস্তা পর্যন্ত, পূর্বে পূবাইল এলাকা পর্যন্ত যানবাহন বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে বলে গাজীপুর জেলা ট্রাফিক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে। গাজীপুরের ট্রাফিক বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার জানান, শনিবার রাত ৩টার পর থেকে রোববার আখেরি মোনাজাতের সময় পর্যন্ত ভোগড়া বাইপাস মোড় থেকে কুড়িল বিশ্বরোড, সাভারের বাইপাইল থেকে আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত অ্যাম্বুলেন্স ও পুলিশের গাড়ি ছাড়া সাধারণ যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে ওই এলাকায় পুলিশের স্টিকারযুক্ত সীমিত সংখ্যক গাড়ি চলাচল করবে।
নিরাপত্তা জোরদার: আখেরি মোনাজাতকে কেন্দ্র করে ইজতেমা ময়দানে নেয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। প্রথম পর্বের আখেরি মোনাজাতে ভিআইপি ও ভিভিআইপিরাও অংশ নেবেন। গাজীপুরের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ বলেন, মুসল্লিদের নিরাপত্তা দিতে পুলিশ তৎপর। সিসিটিভির মাধ্যমে ইজতেমা ময়দান ও আশপাশের এলাকা সার্বক্ষণিক মনিটরিং করা হচ্ছে। যে কোনো ধরনের নাশকতা মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে সাদা পোশাকে গোয়েন্দা বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য। মুসল্লিদের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত তারা এখানে দায়িত্ব পালন করবেন।