আলোচক,তামান্না কবির শিমু (বেরোবি প্রতিনিধি):
গুস্তাভ ফ্লবেয়ার ও এমিল জোলার সার্থক উত্তরসাধক হিসাবেই মোপাসাঁর সাহিত্যজীবন শুরু। পুরো নাম “গী দ্যা মোপাসাঁ”। উনিশ শতকের ফরাসি সাহিত্য আন্দোলনের সময়ে তার অার্ভিভাব। সেই সময়ের স্রোতধারায় মাথা উঁচু করে তার কাঁটে ১৫ বছরের সক্রিয় সাহিত্য জীবন।
গী দ্যা মোপাসাঁ’র চৌদ্দটি অনবদ্য ছোট গল্পের অনুবাদ সংকলন “শ্রেষ্ঠ গল্প”।
যার প্রতিটা গল্প সহজ ভাষায় অসাধারণ।
প্রথম গল্প ‘নেকলেস’। গল্পটি যেমন বহুল পঠিত ও সমাদৃত তেমনি আর্কষনীয়।আমাদের দেশে উচ্চ মাধ্যমিক বাংলা বইয়ে নেকলেস গল্পটি স্থান করে নেয়।
বাস্তব জীবনে মোপাসাঁ সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করেনি।জীবনে টিকে থাকার দায় নিয়েছিলো কেরানির চাকুরী নিয়ে।তাই তো ‘নেকলেস’ গল্পটিতে সাংসারিক অভাব,দৈন্য,ভোগবিলাস তিনি নিখুঁত ভাবে তুলে ধরেছেন।
গল্পের কেরানি ‘লয়সেল’কে লেখক সৃষ্টি করেন নি।লেখক নিজেই ‘লয়সেল’। গল্পে কেরানি লয়সেলের বউ মাদাম লয়সেলের উচ্চ বিলাসিতায় দুজনের জীবনকে দুর্বিসহ করেছে।বান্ধবীর থেকে ধার করা নকল গয়না হারিয়ে জীবনের মুখ্য সময়গুলো কাটলো তার ঋণ শোধ করে।
দ্বিতীয় গল্প ‘নববর্ষের উপহার’। জাক দা রাঁদাল গল্পের নায়ক।তার প্রেমিকা ইরানি।ছ’মাস আগে রাঁদালের জীবনে এই প্রেমিকার উদয়।যদিও ইরানি অন্যের স্ত্রী। ইরানি নববর্ষের উপহার হিসাবে রাঁদালের হৃদয় পেতে চায়।তার সুত্র ধরেই রা্দালের ঘরের দুয়ারে নববর্ষের রাতে আঘাত করে ইরানি।তারপর কথোপকথন।অতঃপর ইরানির জয়। মৃদুস্বরে সে বলতে লাগলঃ
” আমার নববর্ষের একটা উপহার পাবার সাধ হয়েছিল-তোমার হৃদয়ের উপহার-তোমার সদ্য পাঠানো নেকলেসটার পাশে আর একখানি উপহার।তুমি আমাকে তা দিয়েছ।অসংখ্য ধন্যবাদ! ধন্যবাদ! যে আনন্দ তুমি আমাকে দিলে তার জন্য ঈশ্বরকেও ধন্যবাদ!”
তৃতীয় গল্প “প্রেম”
গল্প কথকের শিকারীর নেশা।রক্তাক্ত পশুর দৃশ্য, পশু এবং হাতে লাগা রক্ত দেখলে লেখকের হৃদয়ের স্পন্দন বেড়ে যায়। এরপর কথক স্মৃতিচারণ করে কার্ল দ্যা রাভিলকে নিয়ে প্রাণী স্বীকার করতে যাওয়ার ঘটনা।
এখানে প্রাণীদের প্রেম,ভালোবাসা তিনি স্পষ্টরুপে দেখেছেন। তাই তিনি খবরের কাগজে নাটকীয় প্রেমের বৃত্তান্ত পড়ে অভিভূত, আশ্চর্য হননি। এমনকি তার হৃদয়েও গলে যায়নি কিংবা তাকে ভাবুকও করে তুলেনি। এই প্রেমের ব্যাপারটায় তার কৌতুহল উদ্রেক করেছে কারণ তার স্বীকার জীবনের অদ্ভুত ঘটনা মনে করিয়ে দেয়।
এরপর “বোঝাপড়া” গল্পের প্লটটা অসাধারণ। দুজন স্বামী-স্ত্রী মধ্যে বোঝাপড়া পাঠক হিসাবে আমাকে অভূভিত করেছে।অন্য নারীতে আসক্ত স্বামীকে ফিরিয়ে এনে স্ত্রী মার্গারেট কথোপকথন এবং উপস্থাপন কৌশল মুগ্ধ করার মত। এরপর ‘অনুতাপ’,’প্রতিহিংসা’ সহ আরো আটটি গল্প।
“বেড নম্বর ২৯” গল্পের নায়িকা ইর্মা।সে এপিভেঁত নামক এক ক্যাপ্টেনের প্রেমিকা। ক্যাপ্টেন ছিল যেমন সুন্দর তেমনি অহংকারী। সুন্দরীরা মেয়েরা তার আশপাশের ঘুরঘুর করলেও সে কাউকে মনোনীত না করলে কেউ তার কাছে ঘেঁষতে পারত না। কিন্তু একটা সময় ইর্মা আর এপিভেঁতের প্রেমের বিজয়ী পতকা উড়তে লাগলো।এরমধ্যে এপিভেঁত কে যুদ্ধে যেতে হয়। একটা চক্রের ফাঁদে পরে ইর্মা। শত্রুপক্ষ জোর করে ইর্মাকে নিয়ে গেলেও ইর্মা ব্যর্থ হয়না।তার শরীর সুপ্ত রোগ ছড়িয়ে দেয় শত্রুপক্ষের মাঝে। সে সকলের অলক্ষ্য-অগোচরে অনেক শত্রু মারে।সেও যোদ্ধা। দেশপ্রেম কারো থেকে কোন অংশে ইর্মার কম ছিল না। কিন্তু সকলে তাকে ঘৃণা করে সে শত্রুপক্ষের সঙ্গে মিশেছিলো বলে। অথচ সকলের অগচরে সে কম শত্রু মারেনি।কারো কারো থেকে সে অনেক শত্রু মারতে পেরেছিল।
প্রতিটি গল্পই হৃদয়স্পর্শী।
‘একজন যাত্রীর গল্পে’একজন ডাক্তার যাত্রাকালে তার রোগীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা অন্য যাত্রীদের শোনান। সে ঘটনা অদ্ভুত, আশ্চর্য। যেমন রহস্যজনক তেমনি হৃদয়স্পর্শী।
কিন্তু তারচে হৃদয়স্পর্শী
বইটির শেষ গল্প ‘একটি সুতোর কাহিনি’।
একটি সুতোকে কেন্দ্র করে এ গল্পের অগ্রসর।এতে ফেঁসে যায় একজন অসহায় মানুষ। নাম হাসেকর্ন।
হাসেকর্ন শহরের রাস্তা থেকে একটি সুতো মাত্র কুড়িয়ে নেন।সেই শহরেই হারিয়ে যায় একটা কালো চামড়ায় বাঁধাই পকেটবুক।তাতে পাঁচশত ফ্রাঁ ও দরকারি কাগজপত্র ছিল।
সকলেট ধারনা হাসকের্ন রাস্তা থেকে সুতো নয়,কালো পকেট বুকটি তুলে নিয়েছে।
মেয়র অপিসে তার ডাক পড়ল।সে কাউকে কোনভাবেই বোঝাতে পারল না,সে চুরি করেনি।সে যত প্রমাণাদির উপস্থাপন করল,কৌশলে যুক্তির জাল বুনলো ততই লোকে তাকে অবিশ্বাস করতে লাগল।
হাসকের্ন নিজেকে নির্দোষিতার প্রমানে ব্যর্থ চেষ্টায় সে ক্রমশ কাহিল হয়ে পড়ল।সে বিছানা নিল,একসময় তার জীবন প্রদীপ নিভে গেল।
শুধু একটুকরো সুতোই হাসকের্ন রাস্তা থেকে কুড়িয়ে নিয়েছিল,যার জন্য তার প্রাণ গেল।তবুও কাউকে বিশ্বাস করাতে পারলো না তার নির্দোশিতা।
গী দ্যা মোপাসাঁ’র শ্রেষ্ঠ চৌদ্দটি গল্পের নাম ও অনুবাদ—
১.নেকলেস : সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
২.নববর্ষের উপহার : অরুণ চক্রবর্তী
৩.প্রেম : বিমল দত্ত
৪.বোঝাপড়া : বিমল দত্ত
৫.অনুতাপ:অরুন চক্রবর্তী
৬.প্রতিহিংসা:বিমল দত্ত
৭.আরদালি:মীজানুর রহমান
৮.ঘোড়ার পিঠে: সুনীলকুমার ঘোষ
৯.এগারো নম্বর ঘর: গীতা গুহ রায়
১০.ম্যাদমজেল ফিফি: সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
১১.একজন যাত্রীর গল্প: বিমল দত্ত
১২.শিল্পী: সুনীলকুমার ঘোষ
১৩.বেড নম্বর ২৯: সুধাংশুরঞ্জন ঘোষ
১৪.একটি সুতোর কাহিনি:বিমল দত্ত।
স্বভাবগত ভাবে অল্পভাষী ছিলেন মোপাসাঁ।তার কলমেও স্পষ্ট। অহেতুক কিংবা অমূলক কথায় টেনেটুনে গল্প বড় করার প্রয়াস তার ছিল না।তার এই এক-একটা ছোটগল্প একেক ধরনের শিক্ষা দিয়েছে।
তিনি ১৮৫০ সালের ফ্রান্সের নরমান্ডিতে জন্ম নেন।১৮৯০ সালে তার জীবনে সর্বশেষ রচনা ছিল-La vee Errante (travel).এরপর তিনবছর তিনি দূর্বিসহ দিন কাঁটান পাগলা গারদে।
১৮৯৩ সালে মাত্র ৪৩ বছর বয়সে তিনি মারা যান।
গী দ্যা মোপাসাঁর মাত্র ১৫ বছরের সাহিত্যিক জীবনে রচনা করেন প্রচুর ছোটগল্প।উপন্যাস,কবিতাতেও তার অবদান কম নয়।